সবাই অলসতা করে। আমি অলসতা করি, আপনার বস অলসতা করে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও অলসতা করে; কেউ-ই এর থেকে মুক্ত নয়। অলসতা হচ্ছে কর্ম ও ইচ্ছের মধ্যকার তফাত। কিন্তু আমরা এটা কেন করি? মানুষের অলসতার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে।
- তারা কাজটিকে ঘৃণা করে অথবা এর মূল্য উপলব্ধি করে না এবং এটি করতে পছন্দ করে না।
- তারা কাজটি বুঝতে পারে না এবং এটি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তার ধারণা নেই।
- তারা অধিক আকষণীয় বা উত্তেজনাপূর্ণ কিছু কাজ করছে। ফলে হাতের কাজটিতে আগ্রহ পাচ্ছে না।
মূলত অলসতা একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া। ফলে মস্তিষ্ক ওপরের তিনটি কারণের যেকোনো একটির প্রতি সাড়া দেয়। শক্তি প্রয়োগ করে অলসতার সাথে যুদ্ধ করা বা অলসতাকে ‘পরাজিত’ করাকে আপাতদৃষ্টিতে কমনসেন্সবিরোধী মনে হতে পারে, তবে অলসতাকে অনিবার্য বা সুষ্ঠু কাজ ভেবে ভুল করা যাবে না। কখনো কখনো অলসতা বিপজ্জনকও হতে পারে।
আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন-‘অলসতা এত খারাপ কেন? এটাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? অধ্যয়ন বা রিপোর্ট তৈরির পরিবর্তে কয়েক মিনিট (যেটা এক ঘণ্টায় রূপ নেয়) ফেসবুক চেক করলে কী হয়েছে? আমার জীবন বা আখিরাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করে রাতভর টিভি দেখায় আমার কী এসে যাবে?
আমার ধারণা, আপনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন। একটু আগে অথবা পরে, অলসতার পরিণতি ঠিকই অনুভূত হবে। এর পরিণাম হয়তো পরীক্ষার পূর্বে শেষ মুহূর্তে এসে রিপোর্ট শেষ করা; মুখস্থ করার প্রচণ্ড মানসিক চাপ অথবা সময় নষ্টের জন্য বেদনাদায়ক অনুশোচনা-যে সময়টা কোনো বড়ো প্রকল্প বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিনিয়োগ করা যেত। অলসতার সবচেয়ে খারাপ পরিণাম হলো-আখিরাত সম্পর্কিত পরিণাম, যখন এই জীবনে ফিরে আসার কোনো সুযোগ থাকবে না। যেমন: পূর্বে বলা হয়েছে-বিচার দিবসের আরেক নাম হচ্ছে ‘অনুশোচনার দিন।’ এটা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস না রাখায় কেবল অমুসলিমদের জন্য অনুশোচনার কারণ হবে না; বরং ভালো কাজে আরও অধিক সময় ব্যয় না করার জন্য মুমিনরাও অনুতপ্ত হবে।
অলসতা একটি বিপজ্জনক খাসলত। হ্যাঁ, যার যার অলসতার নিজস্ব ধরন থাকার পরও আসুন, এটাকে আমরা জীবনধারার অংশ হিসেবে গ্রহণ না করি। এই অভ্যাসটি সমূলে উপড়ে ফেলার যথাসাধ্য চেষ্টা করি, যাতে এটি আমাদের খুব বেশি ভোগাতে না পারে। আসুন, সবাই মিলে অলসতাকে জয় করি!
লক্ষণীয় মজার বিষয় হচ্ছে, ইসলামি ইতিহাসের বিভিন্ন স্কলার অলসতার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের একজন বলেন-
‘আমি তোমাকে অলসতার ব্যাপারে সতর্ক করছি। কারণ, এটি ইবলিসের সৈন্যদের একজন।’
ইবনে আব্বাস-এর চমৎকার একটি উদ্ধৃতি রয়েছে-
‘ঝিমুনি অলসতার সাথে বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে দরিদ্রতার জন্ম দিয়েছে। ‘
নবিজি অলসতা ও (অলসতার একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে) অভাব থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বলতেন-
‘হে আল্লাহ! আমি উদ্বেগ ও দুঃখ, দুর্বলতা, অলসতা, কৃপণতা, ভীরুতা, ঋণের বোঝা এবং মানুষের জবরদস্তির ব্যাপারে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’
আমরা অলসতার প্রধান তিনটি কারণ এবং এর সম্ভাব্য করুণ পরিণতি সম্পর্কে জানলাম। তো এখন আসুন, এটা মোকাবিলার জন্য কিছু করি।
যদি আপনি কাজটিকে ঘৃণা করেন, গুরুত্ব উপলব্ধি না করেন অথবা ভারাক্রান্ত মনে করেন, তাহলে প্রফেশনাল হোন। স্টিভেন প্রেসফিল্ডের The War of Art গ্রন্থে কেবল একজন প্রফেশনাল হিসেবে প্রতিদিনের কাজটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে (অলসতার বিরুদ্ধে) ‘প্রতিরোধ’ যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ঠিক একজন প্রফেশনাল অ্যাথলেট যেমন ভালো লাগুক কিংবা না লাগুক প্রতিদিনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে। ইচ্ছে হোক আর না হোক একজন প্রফেশনাল রাইটার যেমন প্রতিদিন লিখেন। মেজাজ যেমনই থাকুক না কেন, একজন কর্পোরেট প্রফেশনাল প্রতিদিন সকালে কাজে উপস্থিত হন। আপনার কাজের প্রতি পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে এবং আবেগকে একপাশে সরিয়ে রেখে এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
আপনি কাজটি বুঝতে পারছেন না এবং কীভাবে মোকাবিলা করবেন সে ব্যাপারে ধারণা নেই: ইতঃপূর্বে কাজটি করেছে এমন কারও কাছে সাহায্য চেয়ে সহজেই এর সমাধান করে নিতে পারেন। অথবা আপনি কীভাবে টাস্কটি সেরা উপায়ে মোকাবিলা করতে পারেন, তার ওপর অনলাইনে পড়াশোনা কিংবা কলিগদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। কারও সাহায্য চাইতে সংকোচ করবেন না।
আপনি খুব আকর্ষণীয় কিছু নিয়ে কাজ করছেন এটা অতিক্রম করা বাস্তবিকই কঠিন। কারণ, উদ্দীপনামূলক কিছু থেকে মনোযোগ সরিয়ে বিরক্তিকর কিছুতে মন দেওয়া খুব সহজ নয়। আমি এ ক্ষেত্রে বিরক্তিকর কাজটিকে গেমের মতো আকর্ষণীয় করে তোলার সাজেশান দিই।
- আমার ইনবক্সে আসা প্রতিটি টাস্ক দিয়ে একটি ছোটো স্লিপ তৈরি করি, যাতে কাজটি করার নির্ধারিত তারিখ/সময়/বিবরণ ইত্যাদি চিহ্নিত থাকে।
- এরপর আমি রেস্টুরেন্টের শেফ যেমন টিকেট/প্রাইস কার্ড সাজায়, সেভাবে এগুলো সাজিয়ে নিই।
- আমি প্রতিটি টিকেট একটা একটা করে কমিয়ে ফেলি। কিন্তু গেমটি কী? গেমটি হলো এক ঘণ্টার মধ্যে কতগুলো কাজ আমি করতে পারি, নিজেকে তার চ্যালেঞ্জ করা।
দুনিয়াজুড়ে বিচিত্র সব গেমিফিকেশন আইডিয়া আছে। আপনার জন্য উপযুক্ত একটা খুঁজে নিন। আপনার ‘গেম’ অধিক সফল করতে এখানে কিছু টিপস শেয়ার করা হলো:
- প্রতিটি ভালো গেমের সাথে পুরস্কার প্রদানের রীতি প্রচলিত। সুতরাং কতটুকু সময়ে কতটুকু কাজ করলে নিজেকে আপনি কত পয়েন্ট বা কী পুরস্কার দেবেন, তা নিশ্চিত করুন।
- সাধারণ মুক্ত গেমের চেয়ে সময়াবদ্ধ গেমস অধিক মজার। নিজেকে সারাদিন সুযোগ দেওয়ার চেয়ে ‘যত বেশি টাস্কসম্পন্ন করার জন্য’ নিজেকে মাত্র এক ঘণ্টার সময়-সুযোগ বেঁধে দেওয়াটা অধিক আকর্ষণীয়।
- আপনার বন্ধু/সহকর্মীদের সাথে যোগ দিন। সামান্য সুস্থ প্রতিযোগিতা অলসতা জয়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়।
‘পোমোডোরো’ নামক আরেকটি টেকনিক আছে। এটা অলসতাকে পায়ে মাড়িয়ে তিনটি পর্যায়ে কার্যকর উপায়ে কাজ করার জন্য প্রমাণিত। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার পছন্দের।
pomodorotechnique . com-এ ফ্রান্সিসকো সেরিলো পরামর্শ দেন, আপনার কেবল ঠিক করতে হবে, কাজটি ২৫ মিনিট সময়জুড়ে মোকাবিলা করবেন। এরপর ২৫ মিনিটের টাইমার সেট করে আপনাকে শুরু করতে হবে। ২৫ মিনিট সম্পূর্ণ হলে ৫ মিনিট বিরতি দিন; এরপর পরবর্তী ২৫ মিনিটের জন্য কাজ করুন। এমনকী এ সময়টাতে যদি এক টুকরো কাগজের দিকে স্থির তাকিয়েও থাকতে হয়, তারপরও থামবেন না-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সেই ‘পঁচিশ মিনিট’ কাজটি করতে আপনার মানসিক জড়তাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে এবং ২৫ মিনিট পর আপনার থামাটা কঠিন মনে হবে, যদি না আপনি কাজটিকে সত্যি সত্যিই অপছন্দ করেন!
আমার সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের অনেকে এই টেকনিকটি ব্যবহারের আশ্চর্যজনক ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। ২৫ মিনিট সাইকেলের সৌন্দর্য হচ্ছে, এটা ততটা দীর্ঘ নয় যে হ্যান্ডেল করা কঠিন মনে হবে এবং এতটা সংক্ষিপ্তও নয় যে, অগ্রগতিটা নেহায়েত সামান্য মনে হয়। তা ছাড়া পোমোডোরো টেকনিকটা অগ্রতির জন্য আমাদের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে কাজের প্রতি আমাদের উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে এবং অসলসতা ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করে।
এক ধরনের সুপ্ত অলসতা আছে, যেটা বিশেষত প্রোডাক্টিভ মানুষদের মাঝে বেশি দেখা যায়। আমি এটাকে বলি ‘সৃষ্টিশীল অলসতা (Creative laziness)!’
এ ক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভ মানুষ তাদের দিনের অধিক কঠিন কাজগুলো এড়ানোর জন্য অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজে-কর্মে জড়ায়। যেমন ধরুন, আপনার হাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ থাকতে পারে, কিন্তু সেটা ফেলে রেখে আপনি মেইলের জবাব, মিটিং সেট, বাসা পরিপাটি, জিমে যাওয়া, কোনো গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট পড়ার কাজ শুরু করে দিলেন।
সৃষ্টিশীল অলসতার মুডে থাকা অবস্থায় আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি না করার ব্যাপারে নিজেকে কম দোষী মনে হবে, যেহেতু আপনি অন্যান্য ‘প্রোডাক্টিভ’ কাজগুলোতে ব্যস্ত আছেন। এ ধরনের ফাঁদে পড়াটা খুব সহজ।
তাহলে আপনি কীভাবে সৃষ্টিশীল অলসতার মুড মোকাবিলা করবেন?
- এ ধরনের মুডে নিজেকে ধরে ফেলুন। যখন আপনি নিজেকে এমন কোনো কাজ মোকাবিলায় খুব ব্যতিব্যস্ত দেখেন, যেটা মূলত শেষ করা দরকার, বুঝবেন আপনি সৃষ্টিশীল অলসতার মুডে আছেন এবং এর থেকে বেরিয়ে যান!
- গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সকালের প্রথমভাগে সেরে ফেলুন। পোমোডোরো টেকনিকের সাহায্যে নিজেকে ফোকাসড রাখুন।
- কাজগুলোর অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন।
- আবারও শিডিউল করুন অথবা অন্যান্য ‘প্রোডাক্টিভ টাস্ক’ অন্য সময়ের জন্য নির্ধারণ করুন।
- একজন জবাবদিহিমূলক সঙ্গীর সাহায্য নিন, যদি মনে করেন আপনি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন।
আপনার অগ্রাধিকারগুলো সঠিকভাবে নির্ধারণ করুন এবং গুরুত্ব কাজগুলো প্রতিদিন করুন-সৃষ্টিশীল অলসতার শিকার হবেন না, ইনশাআল্লাহ!
এই ব্লগে ফিজিক্যাল ফোকাস এবং ফিসিক্যাল টাইম ম্যানেজমেন্টে আপনাকে সহায়তা করতে অনেক টিপস ও টেকনিকস নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার মনে হয় পর্যাপ্ত হয়েছে। আশা করব, আপনি ব্লগটি বারবার দেখবেন, যাতে কোন টেকনিকগুলো আপনি ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করছেন এবং কোনগুলোতে এখনও উন্নতি দরকার, তা দেখে নিতে পারেন। এই টেকনিক ও টিপস আমার জীবনে বদলে দিয়েছে। আমি দুআ করি, এগুলো আপনার জীবনেও পরিবর্তনের সুবাতাস বইয়ে দিক।
Comments