আদর্শ পরিবার গঠনের সর্বপ্রথম ধাপ শুরু হয়, যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পুরুষরা আমাদের দরজায় করাঘাত করে। তখন আমাদের বেছে নিতে হবে উপযুক্ত পাত্র। যার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা আমাদের সাথে মেলে, তাকেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব। একটি আদর্শ পরিবারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার এটাই সর্বপ্রথম ধাপ।

  • প্রতিপালন মানে ভিত্তি স্থাপন। সুতরাং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মাকে অনাগত সন্তানের প্রতিপালন শুরু করে দিতে হবে। তা হলো, সন্তান প্রতিপালন-সম্পর্কিত বইপুস্তক ও আর্টিকেল অধ্যয়ন করা। বিশেষ করে, কন্যাসন্তানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তর সম্পর্কে মাকে আগে থেকে অধ্যয়ন করতে হবে।
  • সন্তান গর্ভাশয়ে আসার পর থেকেই তার যত্ন নেওয়া মায়ের কর্তব্য। সে সময় থেকে সুচারুরূপে গর্ভস্থ সন্তানের যত্ন নিতে শুরু করলে মা ও সন্তান আল্লাহর রহমতে অনেক রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। আর গর্ভবতী মা লাভ করেন একটি সুস্থ ও নিরাপদ জীবন। তাই গর্ভবতী মাকে প্রথমে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে এবং এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে, যা তার এবং তার পেটের সন্তানের জন্য উপযোগী।
  • পারিবারিক জীবন নিয়ে রাসুল-এর স্পষ্ট সুন্নাহ ও নির্দেশনা আছে আমাদের জন্য। তন্মধ্যে সহবাসের আদব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সহবাসের সময় রাসুল-এর নির্দেশনা অনুসরণ করলে সন্তান শয়তানের আক্রমণ থেকে যুগ যুগ ধরে সুরক্ষিত থাকে। এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস এক থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুল ও ইরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমাদের কেউ স্ত্রী-সহবাস করার সময় বলে:
    بِاسْمِ اللهِ اللَّهُمَّ جَنَّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنَّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا

আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন এবং আমাদের যে রিজিক (সন্তান) দান করেছেন, তা থেকে শয়তানকে দূরে রাখুন।” অতঃপর এ সহবাসের কারণে যদি দুজনের জন্য সন্তানের ফয়সালা করা হয়, শয়তান সে সন্তানের ক্ষতি করতে পারবে না।

[সহিহুল বুখারি: ১৪১, সহিহু মুসলিম: ১৪৩৪]
  • আমাদের শিশুরা অনেক সময় মনুষ্য ও জিন শয়তানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফলে তারা আক্রান্ত হয় কারও বদ-নজরের কিংবা জিনের ক্ষতিকর স্পর্শের। তাই মায়ের উচিত, সন্তানের ঝাড়ফুঁক থেকে উদাসীন না থাকা। এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবিজি হাসান ও হুসাইন-কে ঝাড়ফুঁক করতেন এবং বলতেন, “তোমাদের পিতা (ইবরাহিম) ইসমাইল ও ইসহাক-কে এ দুআ পড়ে ঝাড়ফুঁক করতেন:
    أعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ
    “আমি আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ কথামালার মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি সকল শয়তান, ক্ষতিকর প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট হতে।”[সহিহুল বুখারি: ৩৩৭১]
  • কন্যাসন্তানের একটি সুন্দর, অর্থবহ ও যুগোপযোগী নাম রাখা পিতামাতার কর্তব্য। কারণ, সে তার পুরো জীবনে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনবে, তা হচ্ছে তার নাম। অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের এমন নাম রেখে বসেন, যার জন্য বড় হওয়ার পর তাকে অনেক বিব্রত হতে হয়। সন্তান নিজের নাম নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হলে বড় হওয়ার পরে হলেও নামটি পরিবর্তন করে দিতে হবে।
  • মেয়েকে প্রতিদিনের নির্ধারিত আজকার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দুআসমূহ শিখাতে হবে এবং ধীরে ধীরে সেগুলোর ওপর অভ্যন্ত করে তুলতে হবে। অনুরূপভাবে তাকে প্রতিদিনের ফরজ ইবাদত শিক্ষা দিতে হবে এবং যথাসময়ে তা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাকে জানিয়ে দিতে হবে, এ ইবাদত ও আজকারের ওপর অটল থাকলে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সকল ধরনের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত রাখবেন।
  • শিশুর প্রতি মায়ের আদর-মমতা ও যত্ন শিশুর মনকে আকর্ষণ করে। ভবিষ্যতে মায়ের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই মায়ের উচিত, শিশুর মনে সর্বোত্তম উপায়ে মায়া-মমতা ও ভালোবাসার বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া।
  • শিশুর প্রতি আদর-মমতা প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন এবং তার সকল ইচ্ছা ও চাহিদাকে কোনোরূপ বাধা ছাড়া সমর্থন করা শিশুর মনে একটি ভুল ধারণা সৃষ্টি করে যে, সে আজীবন এভাবে আদর-মমতা ও সমর্থন পেতে থাকবে। ফলে যখন তার পরে কোনো ভাই বা বোন আসে, তখন নতুন সন্তানের প্রতি বাবা-মার আদর-মমতা বেশি দেখতে পেয়ে সে মানসিকভাবে আহত হয়। নবজাতক ভাই বা বোনকে নিজের বঞ্চনার কারণ মনে করে তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। সে মনে করে, বাবা-মা তাকে এখন আগের মতো দেখতে পারেন না। ফলে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাই কচি হৃদয়ের শিশুদের ব্যাপারে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সাথে ফেলতে হবে। শিথিলতা ও বাড়াবাড়িমুক্ত উত্তম ও সুন্দর উপায়ে তাদের সাথে আচরণ করতে হবে।
  • মাতৃত্ব মানে সন্তানের সকল আবদার পূরণ করা নয়; বরং মাতৃত্ব অর্থ হচ্ছে, মায়া-মমতা ও বিবেক, স্বার্থ ও প্রয়োজন এবং নম্রতা ও কঠোরতার মাঝে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন। এটাই সন্তানের ব্যাপারে মায়ের প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান।
  • অনেক সময় মা সন্তানের প্রতি মায়া-মমতার আধিক্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। সে সময় মায়ের মমতা এবং পিতার হিকমাহ তথা প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণের মধ্যে সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়ে। এতে আল্লাহর রহমতে সন্তানদের জীবন সুখ ও কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
  • মা যদি তার ছোটবেলায় পিতামাতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থাকেন, সেটা সন্তানদের সাথে তার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং কন্যাশিশু যদি জীবনের শুরুলগ্নে কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় অথবা বাল্যকালেই মা-বাবাকে হারিয়ে ফেলে, সেটা তার ব্যক্তিত্বে এবং ভবিষ্যতে তার সন্তানদের সাথে আচরণে একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে নিজ সন্তানদের মাধ্যমে নিজের অতীতের সকল বঞ্চনা পুষিয়ে ফেলার চেষ্টা করে এবং তা করতে গিয়ে চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করে বসে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তান লালনপালনে অত্যন্ত কঠোর পদ্ধতি বেছে নেয় এবং নিজের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এটাকেই সন্তান প্রতিপালনের আদর্শ পদ্ধতি মনে করে। তাই আমাদের জেনে নিতে হবে যে, অতীত জীবনে যত নেতিবাচক ঘটনা ও অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে ঘটেছে, তার কোনোটিই আমাদের সন্তানদের ওপর প্রয়োগ করা যাবে না। বরং জীবনের সুন্দর ও আলোকিত বিষয়গুলো দ্বারা উপকৃত হয়ে সেগুলো সন্তানদের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করব এবং নেতিবাচক বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তা থেকে আমাদের সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করব।
  • সন্তান লালনপালনের ভার গৃহপরিচারিকার ওপর ছেড়ে দিলে মা ও শিশুর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে। শিশুর সাথে ভালোবাসার বন্ধন গড়তে হলে তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করতে হয়, কোলে নিতে হয়, যত্ন নিতে হয় এবং তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হয়। কাজের ব্যস্ততার কারণে শিশুর যত্ন নিতে সমস্যা হলে গৃহপরিচারিকার সাহায্য নেওয়া যাবে, তবে তা হবে সীমিত পর্যায়ে। খাবারের প্রস্তুতি, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কাজ পরিচারিকা দিয়ে করিয়ে সন্তানের মূল দেখাশোনা মাকেই করতে হবে। যদি একান্তই কারও সাহায্য নিতে হয়, তাহলে শিশুর দাদি কিংবা অন্যান্য মহিলা আত্মীয়ের সাহায্য নেব, যতক্ষণ না কাজ থেকে ফিরে আসি। কিন্তু কাজ থেকে ফিরেই সন্তানের যত্ন নেওয়ায় আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং তাকে একদম চোখে চোখে রাখতে হবে।
  • চাকুরিজীবী মা সন্তানদের খুব কম সময় দিতে পারেন। ফলে শিশুরা মমতা ও যত্নের বড় একটি অংশ থেকে বঞ্চিত হয়। এ জন্য আমরা যারা চাকুরি করি, তাদের উচিত কাজ থেকে ফিরে আসার পর পূর্ণ সময় সন্তানদের সাথে ব্যয় করা। বাড়িতে আসার পরেও অফিসের কাজ ও ফিকির নিয়ে পড়ে থাকা মোটেই উচিত নয়।
  • বড় শহরগুলোতে জীবন ও জীবিকার চাহিদা একটু বেশি। এ কারণে জীবনের সিংহভাগ সময় জীবিকার চাহিদা পূরণে ব্যয় হয়ে যায়। সন্তানদের যত্ন তো দূরের কথা, নিজের জীবনের যত্ন নেওয়ার ফুরসতটুকুও পাওয়া যায় না অনেক সময়। তাই মায়ের উচিত, সময়কে ভাগ করে নেওয়া। কখন জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যাবেন এবং কখন সন্তানকে সময় দেবেন, তার রুটিন ঠিক করে নিতে হবে। প্রত্যেক প্রয়োজনের জন্য বারবার বাইরে না গিয়ে একবারে অনেক কাজ করে নিতে হবে। যে সময় বাইরে প্রচুর ভিড় থাকে অথবা সড়কে জ্যাম থাকে, সে সময়গুলোতে বের না হয়ে অন্য সময়ে বের হলে অনেক সময় বেঁচে যায়। বাড়িতে স্বামী অথবা বড় সন্তান থাকলে বাইরের কাজগুলো তাদের সোপর্দ করে দিয়ে বাড়ি থেকে একদম বের না হওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম।
  • পরিবার বড় হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির কাজও বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় বাড়ির আসবাবপত্রও। সবকিছু পরিচ্ছন্ন ও ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব পড়ে গৃহিণীর কাঁধে। এ কাজে ব্যয় হয়ে যায় অধিকাংশ সময়। ফলে গৃহিণী মা সন্তানের খোঁজখবর নেওয়ার তেমন সুযোগ পান না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যেকোনো উপায়ে কমিয়ে আনতে হবে বাড়ির অতিরিক্ত কাজের চাপ।
  • নারী হলো বিভিন্ন ধরনের দয়া ও আবেগ-অনুভূতির পাত্র। তাকে সন্তানদের অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে মমতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। আবার সময়ের পরিবর্তনে মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। তাকে বুঝে নিতে হয়, ছোট সন্তানের কেমন সহানুভূতি প্রয়োজন আর বড় সন্তানের প্রতি কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে।