বিবাহের হিকমত: প্রতিটি সৃষ্টিকুলে বিবাহ ও বৈবাহিক সম্পর্ক আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনগুলোর একটি নিদর্শন। এটি জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মাঝে সাধারণভাবে উন্মুক্ত। আর মানুষের প্রসঙ্গটি মহান আল্লাহ তার অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় যৌনচর্চা করার পথ খোলা রাখেননি। বরং তার উপযুক্ত সম্মানজনক বিধি-বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যার দ্বারা মানব জাতির মর্যাদার রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্মান হেফাযত হয়। আর তা হলো শরিয়ত সম্মত বিবাহ। এর দ্বারা একজন পুরুষের অপর মহিলার সাথে সম্মানজনক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এটি উভয়ের সন্তুষ্টি ও ইজাব-কবুল এবং ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের প্রতীক। এর দ্বারা সঠিক পদ্ধতিতে যৌন চাহিদা মেটানো হয়। আর বংশানুক্রম বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং মহিলারা হেফাজতে থাকে প্রত্যেক ক্ষতিকারীর ক্ষতি থেকে।
আল্লাহ তা’আলার বাণী-
“আর এক নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সহধর্মীনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পারিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নির্দেশনাবলী রয়েছে।” [সূরা রুম: আয়াত-২১]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা নবী করীম (সঃ) এর সাথে এমন সব যুবক ছিলাম যাদের কিছুই ছিল না। রাসূলুল্লাহ আমাদের জন্য বললেন: “হে যুবকের দল! তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি ‘বা’আত’ তথা দৈহিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাখে সে যেন বিবাহ করে; কারণ এটি চক্ষুকে নিচু রাখে এবং যৌনাঙ্গকে সংরক্ষণ করে। আর যে সক্ষম হবে না তার প্রতি রোযা; কারণ রোযা হল তার যৌন ক্ষমতার জন্য দমনকারী।” (বুখারী: হাদীস নং ৫০৬৬ শব্দ তারই মুসলিম হাদীস নং ১৪০০)
১. বিবাহ এমন একটি কাজ যা দ্বারা সৎ পরিবেশ ও সুন্দর সমাজ গঠন এবং পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার বিষয়ে সাহায্য করে। আর জীবনকে পূত-পবিত্র রাখে ও হারামে পতিত হওয়া থেকে সংরক্ষণ করে। এটি এক বাসস্থান ও প্রশান্তি। এর দ্বারা সৃষ্টি হয় ভালোবাসা, প্রণয়, মিল-মহব্বত ও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রসারিত হয় প্রফুল্লতা।
২. বিবাহ হচ্ছে: সন্তান জন্মের সর্বোত্তম পন্থা এবং বংশকুল সংরক্ষণের পাশাপাশি বংশ বিস্তার করার জায়েয পদ্ধতি। এর দ্বারা জন্ম নেয় আপোষের মাঝে পরিচিতি, সাহায্য-সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব।
৩. বিবাহ হচ্ছে- যৌন চাহিদা মেটানোর এক উত্তমপন্থা এবং হরেক করমের রোগ-বালা থেকে নিরাপদে থেকে যৌন চাহিদা পূরণ করার একমাত্র হালাল পন্থা।
৪. বিবাহের দ্বারা সৎ পরিবার গঠন হয়, যা সুন্দর সমাজের জন্য একটি ভাল বীজ স্বরূপ। স্বামী কষ্ট করে আয় উপার্জন করে, খরচ ও ভরণ পোষণ করে আর স্ত্রী সন্তানদের লালন-পালন করে এবং সংসার পরিচালনা ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণ করে। এর দ্বারা সুসংগঠিত হয় সমাজের অবস্থা।
৫. বিবাহ দ্বারা পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব স্বভাব পরিতৃপ্তি হয় যা সন্তানদের উপস্থিতিতে বেড়ে যায়।
আল্লাহ তা’আলা একজন পুরুষের জন্যে সর্বোচ্চ চারজন মহিলাকে বিবাহ করা জায়েয করেছেন এর অতিরিক্ত চলবে না। কিন্তু শর্ত হলো তার দৈহিক, অর্থনৈতিক ও তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। একাধিক বিবাহের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপকার। যেমন: লজ্জাস্থানের হেফাজত, যাদের বিবাহ করবে তাদেরকে পূত-পবিত্র রাখা এবং তাদের প্রতি ইহসান করা। এ ছাড়া বংশের বিস্তার লাভ, যার দ্বারা উম্মতের সংখ্যা এবং আল্লাহর ইবাদতকারীদের সংখ্যা বাড়ে। অতএব, যদি ভয় করে যে, তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না তাহলে শুধুমাত্র একজন স্ত্রীকে বিবাহ করবে অথবা দাসী গ্রহণ করবে। আর দাসীর জন্য পৃথক কোন দিন ভাগ করা ওয়াজিব নয়।
১. আল্লাহ তা’আলার বাণী: “আর যদি ইয়াতিম মেয়েদের ব্যাপারে যথাযথভাবে তাদের অধিকার পূরণ করতে পারবে না এ ভয় কর, তবে সেসব নারীদের মধ্য থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ সম্ভাবনা থাকে যে, তাদের মাঝে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারবে না তবে একটিই; অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে।” [সূরা নিসা: ৩]
২. প্রজ্ঞাময় মহাজ্ঞানী আল্লাহ একাধিক বিবাহকে যখন হালাল করেছেন তখন অন্য দিকে এটি নিজস্ব আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হারাম করে দিয়েছেন। যেমন : দু’ বোনকে একত্রে বিবাহ করা হারাম। অনুরূপ ফুফু ও ভাতিজীকে এবং খালা ও ভাগিনীকে; কারণ এর ফলে সৃষ্টি হবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন ও জন্ম নিবে নানা রকমের আপোষে দুশমনি। নিশ্চয় সতীনদের মাঝে ঈর্ষা বড় কঠিন।
বিবাহের শর্তসমূহ: বিবাহ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্যে শর্ত হলো:
- বর-কনের নির্দিষ্টকরণ।
- বর-কনের উভয়ের সন্তুষ্টি।
- অলি ব্যতীত কোন নারীর বিবাহ বৈধ নয়।
- মোহরানা দ্বারা বিবাহ সংঘটিত হওয়া।
- বর-কনেকে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হওয়া যেমন: দু’জনের বা কোন একজনের মাঝে এমন কিছু পাওয়া, যা বিবাহকে বাধা দেয়। চাই তা বংশের জন্য হোক বা অন্য কোন কারণের জন্য হোক যেমন: দুধ পান ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ইত্যাদি।
অভিভাবককে পুরুষ, স্বাধীন, সাবালক (প্রাপ্তবয়স্ক), বিবেকবান ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া শর্ত। বর-কনের দ্বীন একই হওয়া শর্ত। নও মুসলিমা নারী যার কোন অভিভাবক নেই তার অভিভাবক দেশের বাদশাহ নিজেই বা তাঁর প্রতিনিধি। অভিভাবক মেয়ের বাবা, তিনিই তার বিয়ে দেয়ার সর্বাধিক হকদার। অত:পর বাবা যার অসিয়ত করবেন। এরপর দাদা। এরপর ছেলে অত:পর ভাইয়ের পর চাচা। অতঃপর বংশের সবচেয়ে নিকটের আসাবা (আসাবা বলা হয়: নিকটাত্মীয় না থাকা অবস্থায় দূরবর্তী যেসব আত্মীয়-স্বজন মৃতের উত্তরাধিকার লাভ করে।) এরপর দেশের বাদশাহ।
বিবাহের আক্বদের সময় সাক্ষী রাখার হুকুম: বিয়ের আক্বদের জন্য দু’জন বিবেকবান ও সাবালক এবং ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী থাকা ওয়াজিব। যদি বিবাহের প্রচার হয় এবং তার ওপর দু’জন সাক্ষী রাখা হয় তবে উত্তম। আর যদি দু’জন সাক্ষী ব্যতীতই প্রচার হয় অথবা সাক্ষী রাখা হয় প্রচার ছাড়া তবুও বিবাহ বিশুদ্ধ হবে।
- যখন নিকটের অভিভাবক বাধা দিবে অথবা অভিভাবক যোগ্য না কিংবা অনুপস্থিত থাকবে যার সাক্ষাৎ কষ্ট ব্যতীত অসম্ভব, এমন অবস্থায় তার পরের স্তরের অভিভাবক বিবাহ দিবেন।
- অভিভাবক ব্যতীত বিবাহের হুকুম: অভিভাবক ব্যতীত বিবাহ বাতিল। বিচারকের নিকট তার বিয়ে বিচ্ছেদ অথবা স্বামী থেকে তালাক করানো ওয়াজিব। আর যদি বাতিল বিয়ের দ্বারা সহবাস হয় তবে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ বৈধ করার জন্য মহরে মেছাল দিতে হবে।
বিবাহতে কুফু তথা উপযুক্ততা: স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপযুক্ত হওয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য শর্ত হলো: দ্বীন ও স্বাধীনতা। অতএব, অভিভাবক যদি সতী-সাধ্বী মেয়ের কোন ফাজের তথা পাপিষ্ঠ-লম্পটের সাথে কিংবা স্বাধীন মহিলাকে কোন দাসের সাথে বিবাহ দেয়, তবে বিয়ে বিশুদ্ধ হবে। কিন্তু মহিলার জন্য অধিকার রয়েছে বিবাহ বন্ধনে অটুট থাকা অথবা বিয়ে বিচ্ছেদ করা।
যে ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিবাহ করতে চায় তার জন্য মুস্তাহাব হলো: একাকী নির্জনতা ছাড়াই মেয়ের এমন কিছু অংশ দেখা যা তাকে বিবাহের জন্য আকৃষ্ট করে। তার সঙ্গে মুসাফাহ করবে না এবং দেহের কোন অংশ স্পর্শ করবে না ও তার যা দেখবে তা কোথাও প্রকাশও করবে না। নারীও তার প্রস্তাবদাতাকে দেখবে। আর যদি নিজে দেখা অসম্ভব হয় তবে বিশ্বস্ত কোন নারীকে দেখার জন্য প্রেরণ করবে, সে দেখে এসে তার বিবরণ দিবে।কোন নারী স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিবাহ করলে সর্বশেষ স্বামীই শেষ বিচার দিবসে স্বামী হিসেবে পাবে।
অন্য ভাইয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব দেয়ার বিধান: প্রস্তাব বা অন্য কোন বিষয়ে ছবি দেয়া-নেয়া হারাম। আর পুরুষের প্রতি হারাম হলো অন্য ভাইয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব দেয়া। তবে যদি প্রথমজন ছেড়ে দেয় বা তাকে অনুমতি দেয় কিংবা মেয়ের পক্ষ থেকে প্রথম ব্যক্তিকে না করে দেয়, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যদি প্রথম ব্যক্তির প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব দেয় আর বিবাহ হয়ে যায়, তবে আক্বদ বিশুদ্ধ হয়ে যাবে কিন্তু সে পাপী হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমান বলে বিবেচিত হবে।
কন্যার অভিভাবকের প্রতি ওয়াজিব হলো: একজন সৎ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে চেষ্টা-তদবির করা। মেয়ের বা বোনের কোন ভাল ও সৎ ছেলের কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব করায় কোন অসুবিধা বা দোষের কথা নয়।
ইদ্দত পালনকারিণীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার হুকুম: মৃত স্বামী বা তালাকে বায়েনার ইদ্দত পালনকারী নারীকে সুস্পষ্টভাবে বিবাহের প্রস্তাব দেয়া হারাম। তবে অস্পষ্টভাবে প্রস্তাব দেয়া বৈধ। যেমন: পুরুষ বলবে: আমি তোমার মতকে চাই। জবাবে মহিলা বলবে: তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না ইত্যাদি।তিন তালাকের কম তালাকে বায়েনার ইদ্দত পালনকারিণী মহিলাকে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট দু’ভাবেই প্রস্তাব দেয়া জায়েয। কিন্তু রাজ’য়ী তালাকের ইদ্দত পালনকারিণীকে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট যে কোন ভাবেই প্রস্তাব দেয়া হারাম।
তিন তালাকের কম তালাকে বায়েনার ইদ্দত পালনকারিণী মহিলাকে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট দু’ভাবেই প্রস্তাব দেয়া জায়েয। কিন্তু রাজ’য়ী তালাকের ইদ্দত পালনকারিণীকে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট যে কোন ভাবেই প্রস্তাব দেয়া হারাম।
মহিলার আকুদের সময়: পবিত্র ও মাসিক অবস্থায় মহিলার বিবাহের আব্দ করা বৈধ। কিন্তু মাসিক অবস্থায় তালাক দেয়া হারাম। আর পবিত্র অবস্থায় তালাক দেয়া বৈধ। এর হুকুম পরে আসবে (ইনশাআল্লাহ)।
১. বিবাহ বিশুদ্ধ হওয়ার কোন বাধা ছাড়াই (যেমন: দুধ পান ও ভিন্ন দ্বীন ইত্যাদি) বর-কনের অস্তিত্ব থাকা।
২. ইজাব পাওয়া: মেয়ের অভিভাবক কিংবা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে এ বলা যে, আমি তোমার সাথে অমুক কন্যার বিবাহ দিলাম কিংবা তোমাকে মালিক বানিয়ে দিলাম ইত্যাদি শব্দ বলা।
৩. কবুল পাওয়া: স্বামী অথবা তার উকিলের পক্ষ থেকে বলা: আমি এ বিবাহ কবুল করলাম…ইত্যাদি শব্দ বলা। কাজেই, যখন ইজাব ও কবুল পাওয়া যাবে, তখন বিবাহের আক্বদ হয়ে যাবে।
বিবাহ দেয়ার জন্য মহিলাদের অনুমতি নেয়ার হুকুম: মেয়ে কুমারী হোক বা বিবাহিতা হোক তার অভিভাবকের প্রতি ওয়াজিব হলো বিবাহ দেয়ার আগে তার অনুমতি গ্রহণ করা। মেয়ে যাকে ঘৃণা করে তার সঙ্গে বিয়ের জন্য তাকে বাধ্য করা বৈধ নয়। যদি তার অনুমতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত তার বিবাহ দেয় তবে তার বিয়ের আকদ বাতিল করার অধিকার রয়েছে।
খানসা বিনতে খেযাম আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি একজন বিবাহিতা মহিলা ছিলেন। তার বাবা তার অনুমতি ব্যতীতই বিবাহ দেন। আর তিনি এ বিবাহকে অপছন্দ করেন। ফলে নবী করীম( সঃ) এর নিকটে আগমন করলে তিনি তার বিবাহকে বাতিল করে দেন।” (বুখারী হাদীস নং ৫১৩৮)
- নয় বছরের কম বয়সের মেয়ের অনুমতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীতই তার জন্য উপযুক্ত ছেলের সাথে বিবাহ দেয়া বাবার জন্য বৈধ।
- বিবাহের প্রস্তাবের আংটির নামে পুরুষের জন্য স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করা চলবে না; কারণ এটি শরিয়তে হারাম ও কাফেরদের সাথে সদৃশ।
Comments